বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার জনক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর হাত ধরে বাংলা সাহিত্য আধুনিকতার পথে যে যাত্রা শুরু করে, তার বিকাশ শ্রীবৃদ্ধি হয়ে ফুলে-ফলে সুবাসিত হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের হাতে। সাহিত্য ও সংস্কৃতির এমন কোন গলিপথ নেই রবীন্দ্রনাথ যে পথে হাঁটেননি। তার সাহিত্য সাধনার বিশ্বস্বীকৃতি পান ১৯১৩ সালে নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে। বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথ উভয়ের ভিতর বাকদেবী তথা কাব্যলক্ষ্মীর প্রতি বন্দনা বা শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন লক্ষ্যণীয়। মাইকেল মধুসূদন তার মহাকাব্য ‘মেঘনাদ বধ’ রচনার শুরুতে যেমন “গাইব মা বীর রসে ভাসি, মহাগীত”; তেমনি রবীন্দ্রনাথ তার বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে জীবন দেবতার অস্তিত্ব অনুভব করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ‘চিত্রা’ কাব্যের যুগে এসেই প্রথম দেবতা সত্ত্বার সন্ধান লাভ করেন। চিত্রা কাব্যে জীবন দেবতা চেতনা মূলক কবিতাগুলো আলোচনা করলে আমরা রবীন্দ্রমানসের একটি অনন্য সাধারণ এবং স্বতন্ত্র রূপের সন্ধান পাই। সমস্ত সাহিত্য প্রচেষ্টার মূল শক্তির উৎস রূপে সমস্ত ভাবনা চিন্তা ও কর্মের নিয়োগের রূপ ও রূপান্তরের পরিচালক রূপে জীবন দেবতার এই বিচিত্র রহস্যময় অনুভূতি রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ নিজস্ব। রবীন্দ্র সাহিত্যে যে সমস্ত দুরূহ আলোচ্য বিষয় আছে, তন্মধ্যে জীবন দেবতাই প্রধান। রবীন্দ্র জীবনের এই জীবন দেবতার অনুভূতি হল তাঁর কবি জীবনের নিয়ন্ত্রণকর্তা বা তাঁর অন্তরের অপরিসীম শক্তিশালী সৃজনী শক্তি। কবি মনে করেন তার অন্তরের অন্তর্বাসিনী কোন এক দেবতাই তাকে নিত্য নব সৃষ্টির প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁর সাথে বিশ্বজগতের সার্বজনীন সত্ত্বার পরিচয় সংগঠিত করে দিয়ে ক্ষণিকের মধ্যে চিরন্তন অনুভূতি লাভের উপলব্ধি দান করেন। এই জীবন দেবতার আবির্ভাব রবীন্দ্রকাব্যে বহু আগেই ঘটেছে। ‘মানসী‘ কাব্যে প্রথম জীবন দেবতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সেখানেই কবি আশা দিয়ে ভালবাসা দিয়ে মানস প্রতিমা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ‘সোনার তরী’তে জীবন দেবতার উপলব্ধি কিছুটা সৃষ্টি হয়েছিল; কিন্তু সত্যিকারের জীবন দেবতার অনুভূতি তখনও ছিল অজ্ঞাত রহস্যময়। তারপর জীবন দেবতার সহিত কবির সত্যিকারের পরিচয় হয় অর্থাৎ জীবন দেবতার সত্যিকার স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেন কবি চিত্রা যুগে উপনীত হয়ে। এই কাব্যেই জীবন দেবতা কবির কাছে অন্তর্যামী হয়ে ধরা দেয়। ‘অন্তর্যামী‘ কবিতায় এই মহাশক্তির লীলার কথা স্পষ্টতই ব্যক্ত করেছেন। এই কবিতায় এসে কবি উপলব্ধি করলেন তাঁর অন্তরের নিভৃততম স্থানে কোন এক নিয়ন্ত্রণকর্তা বসে আছে। এই সত্ত্বাই, কবির জীবনের বড় প্রেরণা। এই অন্তর্যামীই তাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। সেখানে কবির কোন কৃতিত্ব নেই। কবিকে নিয়ে জীবন দেবতা কৌতুকে মেতেছেন। কবি মানসের নিভৃত কোণে বসে এই অন্তর্যামী কবির কাব্য প্রবাহ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাই ‘অন্তর্যামী‘ কবিতায় কবি বলেছেন-
 
“অন্তর মাঝে বসি অহরহ,
মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ
মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ
মিশায়ে আপন সুরে”।
 
এই জীবন দেবতা ব্যক্তিগত জীবনের অধিকর্তা; তিনি বিশ্বদেবতা নন। এই জীবন দেবতা আছে বলেই মানুষের খণ্ড খণ্ড জীবন এক পরম সমন্বয়ের সূত্রে সংযুক্ত হয়ে উঠেছে। নইলে খণ্ড খণ্ডজীবনগুলো সূতাহীন পুঁতির ন্যায় মালা রচনা না করেই ঝরে পড়ত। জীবন দেবতা কবির নিকট বিরাট বিস্ময়। ‘অন্তর্যামী‘ কবিতায় অন্তর্যামীর সাথে কবির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হয়ে আছে এবং কবি তাকে সরাসরি জীবন দেবতা বলে উল্লেখ করেছেন। কবির ব্যক্তি জীবনের সাথে জীবন দেবতার অনন্তলীলা চলছে।
 
কবি জীবনের শত সংকীর্ণতা, অসম্পূর্ণতা, পতন, ত্রুটি সত্ত্বেও জীবন দেবতা কি করে কবির কাব্যকে বিশ্ব জীবনের গণ্ডিতে অবতীর্ণ করেছে, তার গোপন ইতিহাস ব্যক্ত হয়েছে চিত্রা কাব্যের “জীবন দেবতা” কবিতায়। এই কবিতায় কবি জীবন দেবতাকে মহামান্যবর রূপে কল্পনা করে সেখানে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। বধুরূপে তাই আবেগে উৎকণ্ঠিত কবি জীবন দেবতাকে জিজ্ঞাসা করেন-
 
“লেগেছে কি ভাল হে জীবন নাথ,
আমার রজনী, আমার প্রভাত;
আমার নর্ম, আমার কর্ম
তোমার বিজন বাসে?”
 
কবি বলেন, যদি তাকে বঁধুরূপে গ্রহণ করতে জীবন দেবতার ইচ্ছা না হয়, তবে যেন জীবন দেবতা তাকে নতুন করে গ্রহণ করেন। জীবন দেবতা কবির সজীব সত্ত্বাকে পূর্ণতার মধ্য দিয়ে এক অসীম শক্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। জীবন দেবতা কবির ব্যক্তিগত দেবতার বন্দনা। এই ভাবটি কবির জীবনের লীলা রসের অভিজ্ঞতার সাথে মিশে বিচিত্র হয়ে উঠেছে। এই সত্ত্বা  এক হিসেবে প্রেমের বিকাশ। জীবন দেবতা কবির কাব্যের অধিষ্ঠাত্রী, কাব্যলক্ষ্মীর ভাবের সাথে সম্পর্কিত কবিতাগুচ্ছের মধ্যে “রাত্রে ও প্রভাতে” কবিতাটি অন্যতম। এই কবিতায় প্রেয়সী নিশীথে একান্তভাবে কবির ঘনিষ্ঠ ও ব্যক্তিগত বিশ্বের পটভূমি হতে ছিন্ন হয়ে একজনের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ প্রেয়সী মাত্র কিন্তু প্রভাতে তার আরেক অপূর্ব মূর্তি। সে যেন তেমন ঘনিষ্ঠভাবে একজনের মাত্র নয়। ব্যক্তিগত সম্বন্ধ হতে বিচ্ছিন্ন করে তাকে দর্শন করা হয়।
 
জীবন দেবতা মূলক আর একটা কবিতা ‘সাধনা‘। এ কবিতায় কবি অন্তরলোকের কাব্য প্রেরণাদাত্রী দেবীরূপে কল্পনা করেছেন। কবি মনে করেন তার জীবনের সফলতা ও বিফলতাকে সম্পূর্ণ করে দিতে চান এই সত্তা।
 
চিত্রা কাব্যে “সিন্ধুপারে” কবিতা হল জীবন দেবতা কবিতাগুচ্ছের শেষ কবিতা। এই কবিতাটিতে কিছুটা অতি প্রাকৃতিক রস মিশ্রিত। মৃত্যু মানে জীবনের ধ্বংস নয়, পরিপূর্ণতা। এই তত্ত্বটি সিন্ধুপারে কবিতায় রূপকাশ্রিত করে অপূর্বরূপে ব্যক্ত করা হয়েছে। এই কবিতায় জীবন দেবতা রমনী ছাড়া আর কেউ নন। জীবন দেবতার ভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিল বলে এখানে উচ্চাংগের কাব্য সৃষ্টি হয়নি। যে সমস্ত কবিতা জীবন দেবতা দ্বারা সৃষ্টি তার অন্য মূল্য থাকলেও কাব্যমূল্য বেশী নয়।
এই জীবন দেবতা সম্পর্কে রবীন্দ্রকাব্যের মর্মলোচ্য শ্রী চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেনসক্রেটিস বলেছেন-“Daemon/ Dacmon, কৃশ্চানদের কোষের সম্প্রদায় যাকে বলেছেন-” অন্তরের আলোক দার্শনিক, যেনেফার যাকে বলেছেন-ব্যক্তি চৈতন্যাতীত মহাচৈতন্য যা জীবনের পরিচালনি শক্তি: তাকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- “যিনি আমার সমস্ত ভাল-মন্দ, আমার সমস্ত অনুকূল ও প্রতিকূল উপকরণ লইয়া আমার জীবনকে রচনা করিয়া চলিয়াছেন; তাকেই আমি জীবন দেবতা নাম দিয়াছি। যে শক্তি আমার জীবনের সমস্ত সুখ-দুঃখকে, সমস্ত ঘটনাকে ঐক্যদান তাৎপর্য দান করিতেছে। আমার রূপান্তর জন্মান্তর একসূত্রে গাঁথিতেছে। যাহার মধ্যে দিয়া বিশ্ব চরাচরের মধ্যে ঐক্য অনুভব করিতেছি তাহাকেই ‘জীবন দেবতা’ নাম দিয়াছিলাম”।
 
 
‘অন্তর্যামী’ ও ‘জীবন দেবতা’ এ দু’টো কবিতা লেখার পর কবি স্বয়ং প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন“জীবন দেবতা মেটাফিজিক্যাল জীবন দেবতা, আমার জীবনটাকে অবলম্বন করে যে অন্তর্যামী শক্তি আপনাকে অভিব্যক্ত করে তুলেছেন তাই তাকে জিজ্ঞাসা করেছি- ‘আমাকে আশ্রয় করে হে স্বামী তুমি কি চরিতার্থতা লাভ করেছ? যা হতে চেয়েছিলে, যা করতে চেয়েছিলে তা কি সব সম্পূর্ণ হয়েছে?”
 
জীবন দেবতা রবীন্দ্রনাথের অন্তর্যামী শিল্পী সত্ত্বা, তার কবি পুরুষ। জীবন দেবতা কবির সৃজনী প্রতিভার শক্তির উৎস। এই শিল্পী সত্ত্বা নিত্য নতুন প্রেরণা নিয়ে কবিকে সৃষ্টির পথে পরিচালিত করে। বস্তুতঃ বিশ্ব সৌন্দর্যের অনুভূতি এক নয়। সোনার তরী কাব্যের “মানস সুন্দরী বা বিশ্ব সাহিত্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী” চিত্রা কাব্যের জীবন দেবতা পরিণতি লাভ করেছে। তাই জীবন দেবতার মূলে রয়েছে বিশ্ব সৌন্দর্যের চেতনার অখণ্ড অনুভূতি।
 
কবি ব্যক্তি জীবনে শত সংকীর্ণতা, অসম্পূর্ণতা, স্থলন, পতন, ত্রুটি দূর করে দিয়ে জীবন দেবতাকে পরিপূর্ণ বিশ্বজীবনের প্রতীক রূপে প্রকাশ করেছেন। কবির জীবনে জীবন দেবতার আবির্ভাব অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত রূপে হয়েছে। জীবন দেবতার উদ্দেশ্যে কবির অপরিজ্ঞাত ক্ষুদ্র জীবনের নিরালা হৃদয় মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জীবন দেবতার সিংহাসন। কবির সমস্ত কর্মের একমাত্র দ্রষ্টা এই জীবন দেবতা। ভাব, অনুভূতি, চিন্তার একমাত্র যোদ্ধা এই জীবন দেবতা। কবির জীবন দেবতার আবির্ভাবের স্বরূপ সম্বন্ধে এইভাবে একটা ধারণা করা যেতে পারে।
 
  • প্রথমতঃ ব্যক্তিগত জীবন ও সাহিত্য সৃষ্টিতে কবি এক মহাশক্তি বা জীবন দেবতার লীলা অনুভব করেন।
  • দ্বিতীয়তঃ কবির সাহিত্য সৃষ্টির মূল প্রেরণা যোগাচ্ছেন এই জীবন দেবতা। নব নব সৃষ্টির-বেদনার মধ্যে কবি জীবনের জীবন দেবতার প্রভাব উপলব্ধি করেছেন। তার রচনার মধ্যে আত্মকৃতিত্ব নেই, আছে জীবন দেবতার লীলা।
  • তৃতীয়তঃ কবির সাহিত্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে জীবন দেবতা নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ ‘করেছেন। কবি তাঁর কবি জীবনের জন্ম থেকে জীবন দেবতার লীলা অনুভব করতে চান। নবতর ও বৃহত্তর সৃষ্টির প্রেরণা উপলব্ধি করতে চান।
 
এই জীবন দেবতার অনুভূতির স্বরূপই কবি চিত্তে সাহিত্য সৃষ্টির নব নব আবেগ। এই জীবন দেবতাই রবীন্দ্রনাথের জীবনের গভীরতম বৃহত্তম সত্ত্বা। এই সত্ত্বা মানুষ রবীন্দ্রনাথকে দার্শনিক রবীন্দ্রনাথে পরিচালিত করেছে। জীবন দেবতা কবির অতীত, বর্তমান ও অনাগতকে, জড়তা, সমস্ত সুখ-দুঃখ, ভাঙ্গাগড়ার মধ্য দিয়ে পূর্ণ প্রকাশের পথে চালিত হয়েছে। রবীন্দ্র কবি মানসের ধারাবাহিক ইতিহাসে জীবন দেবতার অনুভূতি একটি বিশেষ বিশেষত্ব।
 
রবীন্দ্র কাব্য মানস সুন্দরী বিশ্ব সৌন্দর্য লক্ষ্মী। তাই জীবন দেবতা পরিণতি লাভ করেছে। জীবন দেবতা রবীন্দ্রনাথের জীবনে কিছুটা তত্ত্বের আকারে উপস্থিত হয়েছে এবং কবিও একে অনন্যরূপে গ্রহণ করেছেন।
 
পরিশেষে এক কথায় বলা যায়, জীবন দেবতাই জন্মে-জন্মে কবির ব্যক্তি চেতনার অধীশ্বর।
 
 

 

লেখক পরিচিতিঃ

মোঃ রুহুল আমিন

অধ্যক্ষ, পাঁজিয়া ডিগ্রী কলেজ, ডাকঘরঃ পাঁজিয়া, উপজেলাঃ কেশবপুর, জেলাঃ যশোর। সাংবাদিক ও কলামমিস্ট। মোবাঃ ০১৭১৮-৬১১৫৫০, ই-মেইলঃ  ruhulamin0655@gmail.com

Leave a Comment